হিটলারের উত্থান: নাৎসি জার্মানির জন্ম ও বিকাশ
অ্যাডলফ হিটলার বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র। তার নেতৃত্বেই নাৎসি জার্মানি গড়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে হিটলারের ক্ষমতায় আসা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল এক দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার ফল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অর্থনৈতিক দুর্দশা, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং জাতীয়তাবাদী আবেগের ওপর ভিত্তি করে তিনি নিজের দল গড়ে তোলেন এবং ধীরে ধীরে ক্ষমতায় আসেন।
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও জার্মানির দুরবস্থা
১৯১৪-১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles) জার্মানির জন্য ছিল অপমানজনক। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী—
- জার্মানিকে বিপুল যুদ্ধক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়।
- জার্মান সেনাবাহিনীকে সীমিত করে দেওয়া হয়।
- রাইনল্যান্ডকে নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চলে পরিণত করা হয়।
- জার্মানি তার উপনিবেশ ও কিছু ভূখণ্ড হারায়।
এই শর্তগুলো জার্মান জনসাধারণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও জাতীয়তাবাদী আবেগ তৈরি করে, যা পরবর্তী সময়ে হিটলারের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখে।
২. নাৎসি পার্টির উত্থান ও হিটলারের ভূমিকা
১৯১৯ সালে হিটলার জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে (German Workers’ Party) যোগ দেন, যা ১৯২০ সালে "ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি" (NSDAP) বা সংক্ষেপে নাৎসি পার্টি নামে পরিচিত হয়।
নাৎসি পার্টির মূল আদর্শ ছিল—
- জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা (Aryan supremacy)।
- ইহুদি, কমিউনিস্ট ও অন্যান্য "অবিশ্বস্ত" গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র থেকে বাদ দেওয়া।
- ভার্সাই চুক্তির প্রতিশোধ নেওয়া।
- একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।
হিটলার তার চৌকস বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ উসকে দেন এবং নাৎসি পার্টিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেন।
৩. বিয়ার হল অভ্যুত্থান ও কারাবাস (১৯২৩)
১৯২৩ সালে হিটলার এবং তার দল মিউনিখে একটি অভ্যুত্থান (Beer Hall Putsch) চালানোর চেষ্টা করে, যা ব্যর্থ হয়। তিনি গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন (যদিও মাত্র ৯ মাস কারাগারে কাটান)। কারাগারে থাকার সময় তিনি তার বিখ্যাত বই "মাইন কাম্পফ" (Mein Kampf) লিখেন, যেখানে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
৪. অর্থনৈতিক মন্দা ও হিটলারের জনপ্রিয়তা
১৯২৯ সালের মহামন্দা (Great Depression) জার্মানির অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
- বেকারত্ব আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়।
- ব্যবসা-বাণিজ্য ধসে পড়ে।
- সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
এই পরিস্থিতিতে জনগণ নতুন নেতৃত্বের সন্ধান করছিল। হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকে একমাত্র রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
৫. ১৯৩৩ সালে হিটলারের চ্যান্সেলর নিযুক্তি
১৯৩২ সালের নির্বাচনে নাৎসি পার্টি সর্বাধিক আসন লাভ করে। রাষ্ট্রপতি পল ফন হিন্ডেনবুর্গ বাধ্য হয়ে ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি হিটলারকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন।
ক্ষমতায় আসার পর হিটলার দ্রুত গণতন্ত্র ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যান—
১৯৩৩ সালে রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ড: এই ঘটনাকে ইস্যু করে তিনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন।
১৯৩৩ সালে সক্রিয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: "Enabling Act" পাস করে হিটলার নিজেকে স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
৬. নাৎসি শাসনের বিকাশ ও জার্মানির রূপান্তর
হিটলার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত নাৎসি মতাদর্শকে কার্যকর করতে শুরু করেন—
ক. রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন
- বিরোধী দল নিষিদ্ধ করা হয়।
- গোপন পুলিশ (Gestapo) ও SS বাহিনী গঠন করা হয়।
- কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী ও ইহুদিদের নির্মূলের জন্য পরিকল্পনা শুরু হয়।
খ. অর্থনৈতিক ও সামরিক পুনর্গঠন
- যুদ্ধশিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়।
- গণহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।
- জার্মান সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করা হয় (যা ভার্সাই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন)।
গ. ইহুদি ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন
১৯৩৫ সালে নürenberg Laws জারি করা হয়, যা ইহুদিদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়।
১৯৩৮ সালে Kristallnacht (নাইট অব ব্রোকেন গ্লাস) ঘটানো হয়, যেখানে ইহুদিদের দোকান, উপাসনালয় ও বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়।
৭. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা (১৯৩৯)
হিটলার ক্রমাগত সামরিক শক্তি বাড়িয়ে ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে।
প্রধান আগ্রাসন—
১৯৩৬: রাইনল্যান্ড দখল।
১৯৩৮: অস্ট্রিয়া সংযুক্তকরণ (Anschluss)।
১৯৩৮: Sudetenland দখল।
১৯৩৯: পুরো চেকোস্লোভাকিয়া দখল।
১৯৩৯: পোল্যান্ড আক্রমণ (এর ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে)।
হিটলারের উত্থান ছিল জার্মানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির অসন্তোষ, অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসেন। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি নাৎসি মতাদর্শ বাস্তবায়ন করেন, যা বিশ্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
হিটলারের উত্থান ইতিহাসে এক চরম শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়— যেখানে একটি দেশ ও তার জনগণ ভুল নেতৃত্ব বেছে নিলে তা কীভাবে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

0 Comments:
Post a Comment